Translate

মঙ্গলবার, ২ অক্টোবর, ২০১৮

চিঠি

জীবনে প্রথম প্রেমে পরেছিলাম যে মেয়েটির তাকে সে কথা কখনো বলা হয়নি । সদ্য মাধ্যমিক পেরিয়ে তখন ভর্তি হয়েছি শহরের নাম করা কলেজে । প্রথম ক্লাসেই সেই অঘটন ঘটে গেল, জীবনে প্রথম প্রেমে পড়লাম । কলেজের প্রথম দিন প্রথম ক্লাসে কলেজের অধ্যক্ষ আর নামি দামি প্রফেসররা আসবেন, সবার সাথে পরিচিত হবেন, নতুন ছাত্রদের বরণ করবেন, সে এক এলাহী কান্ড। আমি গ্রাম থেকে উঠে আসা গোবেচারা মানুষ, সামনের সারিতে বসার সাহস হলো না । ভয়ে ভয়ে দ্বিতীয় সারিতে বসে গেলাম । যথারীতি প্রোগাম শুরু হলো । হলরুমে পিন পতন নিরবতা। অধ্যক্ষ মহোদয় কথা শুরু করলেন । মনোযোগ দিয়ে শুনছি । বাইরে অবিরাম বৃষ্টি ঝরছে । সামনের জানালা দিয়ে অবিরল জলের ধারার ন্যায় বাতাস বইছে । একগুচ্ছ গভীর কালো চুল সেই বাতাসে ভেসে আমার চোখ মুখ ছুঁয়ে যাচ্ছে । সদ্য স্নান করে আসা চুলের ঘ্রাণ আর আলতো ছোঁয়ায় কখন যে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি সে আমার জানা নেই । যখন টের পেয়েছি তখন পুরো ক্লাস আমার দিকে তাকিয়ে হাসি আটকাচ্ছে । পরিচিতি পর্বে সবাই যখন নিজের পরিচয় দিচ্ছে, আমি তখন বলছি... চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা।

মুগ্ধতার রেশ কটিয়ে নিজের পরিচয় দিতে খানিকটা সময় লেগেছে সেদিন । মেয়েটি আমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে ঠোটের কোনায় বিপ্রতিপ হাসি এঁকে রাজহংসীর ন্যায় ঘাড় ঘুরিয়ে চুলগুলো সামলে নিল । তবু আমার চোখে মুখে এক অসীম মুগ্ধতার আবেশ রয়ে গেল । আমি প্রেমে পড়লাম । প্রথম দেখায় যে মানুষ প্রেমে পড়ে, সেবার প্রথম আমার বিশ্বাস হলো।

এরপর প্রতিদিন আমি তার ঠিক পেছনটায় বসেছি, সে চুল খোলা রেখেছে, আমি ঘ্রাণ নিয়েছি, মাতাল হয়েছি। তার সাথে কোন কথা হয়নি। চোখাচোখি হয়েছে, সে হেসেছে আমি হাসিতে তার উত্তর দিয়েছি। কোন কথা না বলেই অনেক কথা হয়ে যেতো।

আমি বহুদিন তাকে ভালোবাসি বলবো বলে তার কাছাকাছি গিয়েছি, লজ্জা আর ভয় মেশানো অদ্ভুত এক অনুভূতি নিয়ে ফিরে এসেছি। ভালোবাসি বলা হয় নি । একবার সে কাছে ডেকে বলেছিল, কিছু কি বলতে চাও আমায়? আমি জবুথবু হয়ে বলেছিলাম, না তো! কি বলার আছে, কিচ্ছু না ।
প্রথম সেমিস্টার ব্রেক হলো , এরমধ্যে বেশ কিছু দিন অসুস্থ ছিলাম । সেবার বাড়ি থেকে প্রতিজ্ঞা করে কলেজে গেলাম । যে কোরেই হোক তাকে বলতে হবে -আমি কিছু বলতে চাই । তোমাকে ভালোবাসি একথা বলতে চাই। কলেজের প্রথম আওয়ারেই তাকে বলে দেব।

সারারাত অনুশীলন, মনের ভেতর কত যে আকুলিবিকুলি, একফোঁটা ঘুম আসেনি সে রাতে । আমি সেই নির্দিষ্ট আসনে বসা, শুভা আসবে, আমার সামনের আসনটাতে বসবে, খোলা হাওয়ায় তার এলো চুল উড়বে, আমার চোখে মুখে ছুঁয়ে যাবে । আমি ভালোবাসায় বিভোর হব, চোখ বন্ধ করে আবার মাতাল হবো। অনেক দিন পর আবার আমি স্বপ্নে হারাবো। তাকে ছাড়া যে আমার একেবারেই চলবে না, তারপর তাকে সে কথা বলে দেব।

শুভা এলো না এলো শ্রাবনী। আমার হাতে এক টুকরো কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলল -শুভার চিঠি । আহ্ তাহলে সেও বুঝি ভালোবাসে! লজ্জায় নিজেকে আড়াল করেছে বুঝি! লজ্জা নারীর ভূষণ কি না ! জীবনে প্রথম কোন প্রেমিকার চিঠি আমার হাতে । আহ সেও বুঝি আমারি মত অপেক্ষায় গুনেছে দিন! আনন্দের সকল সীমা ছাড়িয়ে আমি এক অদ্ভুত শিহরণ অনুভব করলাম। এরই নাম বুঝি প্রেম!

কাপাকাপা হাতে চিঠি খুললাম। একটি বাক্য শুধু "ভালো থেকো অরুন" । শ্রাবনী জানালো শুভার বিয়ে হয়ে গেছে । সেদিন ভরা ক্লাসে বাচ্চাদের মত আমি হাউমাউ করে কেঁদেছি। এখনো মনে আছে পুরো ক্লাস আমার দিকে চেয়ে থেকেছিল।

আঠারো বছর পর আজ আবার তার সাথে দেখা। অফিসার্স ক্লাবে, আমাদের পারিবারিক ফাংশনে। তার সাহেব কদিন আগেই এডিশনাল ডিআইজির পদে প্রোমোশন নিয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে যোগদান করেছেন। আমার সরাসরি বস । তার সাথে নতুন করে আলাপ হলো। স্যার পরিচয় করিয়ে দিলেন আমাদের তরুণ, সাহসী অফিসার, সিনিয়র এএসপি অরুণ । স্যার হো হো করে হাসতে হাসতে বললেন, চিরকুমার সংঘের সদস্যও বলতে পারো। আমি সালাম দিলাম, সে মুচকি হাসলো তার পর চোখ থেকে চোখ নামিয়ে নিলো। বিশ্বাস করুন সে হাসিতে কোনো প্রাণ ছিল না । দু চারটা ফরমাল কথা হলো । মেঘের আড়ালে ঢাকাপরা চাঁদের মত একরাশ বিষণ্ণতা তার অবয়ব জুড়ে নেমে এলো। আমি সরে এলাম, কত আর অভিনয় করা যায়!

জানি এর কোন কার্যকরণ হবেনা, তবু আঠারো বছর বুকের ভেতর বয়ে বেড়ানো কথাটা কি তাকে বলা যায় না? অন্তত সে জানুন কেউ একজন এখনো তাকে ভালোবাসে।

বুধবার, ১২ অক্টোবর, ২০১৬

লাশ

মৌমিতা সেজেগুজে শান্তিনগর থেকে বেইলি রোড হয়ে সোজা রমনার দুই নম্বর গেটে এসে যখন দাড়ায় তখন ঘড়িতে দশটা ছুঁইছুঁই। সুমিতের সাথে আজ ১০টায় দেখা করার কথা। মৌমিতা হাত উল্টিয়ে বারবার ঘড়ি দেখছে। এখন ১১টা বেজে আঠার মিনিট অথচ সুমিতের আসার নাম নেই। সুমিত বরাবরই লেট, তবে তা পাঁচ-দশ মিনিটের বেশি গড়ায় না। বেশ কয়েক মাস ধরেই এমনটা হচ্ছে। জিজ্ঞেস করলে বিভিন্ন এক্সকিউজ দেখায়। সুমিত কি তাকে এড়িয়ে যেতে চাইছে! না কি অন্য কিছু? মৌমিতা এই এক ঘন্টায় ফোনে বিশ বারের বেশি ট্রাই করেছে। সুমিতের ফোন ব্যস্ত। আর এখন বন্ধ। কি হল সুমিতের? এতক্ষণ সুমিতের উপর যে রাগ উঠেছিল এখন তা দুশ্চিন্তায় পরিনত হল। এই রহস্যময় শহরের কোন বাকেঁ কোন অমঙ্গল ওঁত পেতে আছে কেউ জানে না। অজানা সঙ্কায় মৌমিতার বুকটা হু হু করে উঠলো।
হাই আপি! কি খবর? এখানে দাড়িয়ে কেন?
রাহাত। সুমিতের পাশের বাসায় থাকে। এদিক দিয়েই যাচ্ছে, হঠাৎ মৌমিতার সাথে দেখা। মৌমিতা হাত উল্টে ঘড়ি দেখে এরপর ওষ্ঠযুগলে সামান্য হাসির আভা ছড়িয়ে দিয়ে বলে, সুমিত আসার কথা। সেই হাসির রেখা ওষ্ঠযুগলেই বিষন্নতায় মিলিয়ে যায়।
আসেনি? ব্যাপার কি বলুন তো! দাদাকে তো দেখে এলাম বাটা সিগনালের পাশে, এলিফ্যান্ট রোডের একটি কানা গলির ভেতরে। সাথে একটা মেয়ে, বেশ সুন্দরী। দুজনকেই বেশ ভীত-সন্ত্রস্ত মনে হল। গুটিসুটি মেরে দাড়িয়ে, সাবধানে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। মেয়েটির চোখে চোখ পড়েছিল। ভয় পাওয়া হরিন শিশুর মত চোখ সরিয়ে নিয়েছে। একে আগেও হয়তো কোথাও দেখেছি। কার সাথে ঠিক মনে নেই।

রাহাতের কথা শেষ হওয়ার আগেই মৌমিতার মাথায় চক্কর দিয়ে ওঠে। মৌমিতা মাটিতে পরে যেতে পারতো, কিন্তু পরলো না, শক্ত হয়ে দাড়িয়ে রইলো। হাতের ইশারায় একটা রিকশা ডেকে উঠে বসলো। বাটা সিগনাল। রিকশাওয়ালা শুনলো কি শুনলো না বোঝা গেল না, ঘার ঘুরিয়ে মৌমির দিকে তাকালো। মৌমিতা আবার বললো বাটা সিগনাল। রিকশা হাতিরপুলের ভেতরের রাস্তা দিয়ে বাটা সিগনালে ডাচবাংলা ব্যাংকের অপজিটে এসে থামে।
একটু দূরেই সুমিত রাস্তা পার হচ্ছে, সাথে মেয়েটি। মৌমিতার চোখ আটকে আছে সুমিতের দিকে। ওরা এখন গলির তৃতীয় বাড়িটির ঠিক সামনে এসে দাড়িয়েছে। মৌমিতা ওদের চোখ এড়িয়ে সন্তপর্ণে রাস্তা পেরুলো। মেয়েটি সামনে সুমিত পেছনে, শা শা করে দ্রুত উঠে পড়লো দোতালা বাড়িটির দ্বিতীয় তলায়। উপরে বড় করে একটা সাইনবোর্ড টাঙানো, ‘কাজী অফিস’। মৌমিতা ভবনটির নিচে এসে দাড়ালো। কেমন যেন একটা শিতল শিহরন তার পা থেকে সারা শরীর হয়ে মাথা অব্দি ছেয়ে গেল। থরথর করে কাঁপছে মৌমিতা। মৌমিতা কাজী অফিসে ঢুকবে, না কি ঢুকবে না? বুকের ভেতরে একরাশ কষ্ট আর ঘৃণা দলা পাকিয়ে আসে। সামান্য অবহেলা যার চোখে কান্নার সাগর নিয়ে আসে আজ তার চোখে কোন পানি নেই। থাক না, বাঁধা দিয়ে কি লাভ? আপন সুখের পথ বেছে নেয়ার অধিকার প্রত্যেকেরই আছে, থাকা উচিত। এই রিকশা যাবে? মৌমিতা একটা রিকশা ডেকে উঠে পড়লো। শান্তিনগর।

সকাল সাড়ে নয়টা। সুমিত রেডি হচ্ছে। ফোনটা বেজে উঠলো। মৌমিতা বোধ হয় বেরিয়ে পরেছে। ওর স্বভাবই এরকম, বাসা থেকে পা ফেলেই ননস্টপ ফোন দেয়া শুরু করে। কতবার যে নিষেধ করেছি, কে শোনে কার কথা? সুমিত ফোনটা বের করে। না। মৌমিতা নয়। রাসেদের ফোন। রাসেদ সুমিতের কাছের বন্ধু। সুমিত ফোনটা রিসিভ করে। হঠৎ একটা বড় রকম বিপদে পরে গেছি দোস্ত। বলিস কি? কি হয়েছে? বলছি, একটা টেক্সি নিয়ে দ্রুত এলিফেন্ট রোডে চলে আয় কুইক। এই আমার আজ তাড়া আছে, জরুরী এপয়েনমেন্ট। আরে রাখ তোর এপয়েনমেন্ট, আমার জীবন মরন সমস্যা, এক সেকেন্ড দেরি করলে আমার সর্বনাশ হয়ে যাবে। রাসেদ বিস্তারিত বলতে থাকে। সুমিত কথা বলতে বলতে একটা টেক্সি ডেকে উঠে পড়লো ।

ওদের বিয়ে শেষ হল রাত ১২ টার দিকে। বিয়ের পর রাশেদ আর সোমাকে নিরাপদে পৌছে দিয়ে সুমিতের ফিরতে প্রায় দেড়টা বেজে গেল। আড়াইটার দিকে সুমিতের অটপসি ক্লাস। স্টুডেন্টরা অপেক্ষা করবে। সুমিত ফোনটা অন করে মৌমিতাকে ট্রাই করে। মৌমিতার ফোন বন্ধ। সুমিতের মন খারাপ হয়ে যায়, বেচারি না জানি কতক্ষন একা একা দাড়িয়ে থেকেছে, অপেক্ষা করেছে। কিন্ত কি করার ছিল তখন? সোমা যেভাবে বাসা থেকে পালিয়েছে! ধরা পরে গেলে দুজনের লাইফই বরবাদ হবার আশঙ্কা ছিল। ক্লাস শেষে যে করেই হোক মৌমির সাথে একবার দেখা করতে হবে। ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললে আশাকরি মৌমি ভুল বুঝবে না। ভাবতে ভাবতে সুমিত কলেজের গেটে এসে পৌছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ। লাশঘরের বাইরে একজন এসআইর নেতৃত্বে কয়েকজন উর্দী পড়া কনস্টাবল দাড়িয়ে। ভেতরে স্টুডেন্টদের জটলা, কানাকানি। এরা সব ফোর্থ ইয়ারের স্টুডেন্ট। সুমিত লাশঘরে প্রবেশ করলো। একটা নতুন লাশ এসেছে। ২০ -২২ বছর বয়সের তরুনী। গলায় ফাঁস নিয়েছে। ঘন্টাখানেক আগে এসেছে লশটা। পরনে নীল শাড়ি, শাড়ির সাথে ম্যাচিং করা ব্লাউজ, কপালে নীল টিপ, খোলা চুল পরিপাটি করে আচঁড়ানো। ভ্রু যুগল গাঙচিলের ডানার মত চোখের দুই দিকে নেমে গেছে। কাজল মাখা চোখ জোড়া বন্ধ করা না থাকলে হয়ত দিঘির মতো গভীর চোখের মায়া ছড়িয়ে পড়তো এই লাশকাটা ঘরটায়। নিষ্পাপ ওষ্ঠযুগলে বেদনার বিন্দুমাত্র ছাপ নেই, মনে হয় এইমাত্র হাসতে হাসতে ঘুমিয়ে পড়েছে।

দক্ষিন এশিয়ার অঞ্চলের মেয়েদের আত্মহত্যার প্রবনতা বেশি, এর বিভিন্ন কারণও রয়েছে। তবে ধনাট্য পরিবারের সুন্দরী, শিক্ষিত কোন মেয়ের আত্মহনন একেবারে বেমানান। শিশির ভেজা ফুলের মত নিস্পাপ সুন্দর মেয়েটা সেজেগুজে কেন আত্মহননের পথ বেছে নিলো? কি এমন ঘটেছিল? এই প্রশ্ন সবার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ছাত্রছাত্রীরা তরুন শিক্ষককে পথ করে দিল। সুমিত লাশটির সামনে এসে দাড়ালো। লাশটি একটি লোহার খাটের উপর চিৎ করে শোয়ানো। মাংসের দোকানিরা যেরকম কাঠের গুড়িতে মাংস বানায়, মাথার নিচে বালিশের পরিবর্তে সেরকম এক টুকরো শুকনো কাঠ। লাশটি একটা সাদা কাপড় দিয়ে আপদমস্তক ঢেকে রাখা হয়েছে। হাতুরি, বাটাল আর ধারালো ছুরি নিয়ে ডোম প্রস্তুত। যে ডোম সম্প্রদায় নির্লিপ্তভাবে মানুষের লাশ কেটে অভ্যস্ত, এই লাশটা বোধহয় তার মনেও দাগ কেটেছে ।

লাশের উপরের কাপড়টা টেনে সরিয়ে দেয়া হল, স্টুডেন্টরা লাশের চারদিকে এসে জড়ো হলো। ডা. সুমিতের চোখ লাশের মুখোমন্ডল বরাবর পরতেই বিদ্যুৎস্পৃষ্ট মানুষের মত তার আপদমস্তক কেঁপে উঠলো। এরপর মৌমি বলে একটা চিৎকার দিয়ে পাথরের ন্যায় দাড়িয়ে রইলো।।

সোমবার, ২৩ মে, ২০১৬

হীরা


পড়ায় মন বসাতে পারছি না। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। হঠাৎ করেই বুকের মধ্যে শুরু হয় তুষার ঝড়। ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটায় কেঁপে কেঁপে ওঠে হৃদপিন্ডের কোমল প্রাচীর। রক্তের সাথে মিশে দেহের অলিতে গলিতে পৌছে। শরীর হিম হয়ে আসে। আমি অস্থির হয়ে উঠি। নাহ্ আর বসে থাকা যায় না, চেয়ার ছেড়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াই। রেলিংটাকে দুই হাতে শক্ত করে ধরি। হন্যে হয়ে খুঁজি চারপাশে। কোথাও নেই।
দশজনের মেস, পুরোপুরি ফাঁকা। বড়রা সবাই বা্ইরের কাজে ব্যস্ত। এ সময়টা আমাকে একাই থাকতে হয়। দূরের আকাশে উড়ছে একটি চিল, সোনালী চিল, একাকি। শেষ বিকেলের নিস্প্রভ রোদ্দুরে পৃথিবীটা বড় বিষণ্ণ লাগে।
কিছুক্ষণ পিনপতন নিরবতা। আবার সেই শব্দ। কান খাড়া করি। চোখ দুটি ব্যাকুল হয়ে খোঁজে। দৃষ্টিরা ফিরে আসে ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে। কবে সে মরে গিয়ে, পঁচে গিয়ে, মাটির সাথে মিশে গেছে হয়তো। এখনও সে আসে, জ্বালাতন করে, সুযোগ পেলেই মাথার ভেতরে বসে থেকে থেকে ডেকে চলে। কেন যে এত বেশি ভালবাসতে গেলাম তাকে। নস্টালজিক হয়ে পরি। স্মিৃতির ভেলায় ভেসে যাই তিন বছর আগের এক দুরন্ত দিনে।
ক্লাস সিক্সে পড়ি। পড়াশুনা তেমন ভাল লাগেনা। নিয়ম মাফিক কোন কাজই আমার পছন্দ নয়। ভাল লাগে পথে-প্রান্তরে ঘুরে বেড়াতে, চৈত্রের দুপুরে সবার অলক্ষ্যে পুকুরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডুবসাতার কিংবা দলবেঁধে ঝাপিয়ে পড়তে আড়িয়ালখাঁর ঘোলা জলে। প্রায়ই স্কুল পালিয়ে গ্রামের বন-বাঁদারে ঘুড়ে বেড়াই, পাখিদের কলকাকলি শুনি, খুঁজে বেড়াই টিয়া, শালিক, ঘুঘু, সোনাঘুঘু, মাছরাঙা আরও কত কি! নারিকেল গাছের গর্তে বাসা বাঁধে টিয়া, শালিক পাখিরা; মাছরাঙারা বাঁধে নতুন পুকুরের পাড়ে মাটিতে গর্ত করে আর ঘন ঝোপঝারের মধ্যে ঘুঘু পাখিরা। এসব মুখস্থ। কিন্তু শিতের শুরুতে যে নানান রঙের পাখিরা এসে মুগ্ধ করতো সারা বিল, তাদের কারো নাম জানা হতো না, জানা হতো না কোথায় তারা বাসা বাঁধে। কাউকে জিজ্ঞেস করা হয়নি কখনো। শুধু মনে মনে খুঁজেছি। আশপাশের দু-চার গ্রামও বাদ পড়তো না পাথির বাসা খুঁজতে। সারাদিন ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে সন্ধ্যায় ফিরতাম দু-চারটা পাখির ছানা হাতে নিয়ে উৎফুল্ল মনে। মা ভীষণ রেগে যেতেন। বলতেন, তপুর কাছে শুনলাম স্কুলে যাসনি। কোথায় ছিলি সারাদিন? দুপুরে কি খেয়েছিস? আর এই আপদগুলো কোথেকে ধরে নিয়ে এসেছিস? এরকম বাদরের মতো সারাদিন ঘুরে বেড়াস। তোদের সাথে আমি আর থাকব না। কালই চলে যাব -দুচোখ যেদিকে যায়। আমার হৃদয় আনচান করতো, কেমন যেন হয়ে যেতাম। সারা দিনের অপরাধের গ্লানি আমার মাথায় বোঝা হয়ে উঠতো। অধঃমুখে বিষণ্ণ মনে দাড়িয়ে থাকতাম। কিছুক্ষণ পর মা কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতেন-লক্ষী বাবা আমার, আর এমনট করিস না। যা হাত মুখ ধুয়ে আয়, ভাত খাবি। ধরা গলায় বলতেন-না খেয়ে খেয়ে কি অবস্থা হয়েছে তোর, দেখেছিস! আমি প্রভুভক্ত বিড়ালের মতো মায়ের কোল ঘেষে বসতাম। মনে মনে বলতাম, তুমি আমার মা… তোমাকে অনেক ভালবাসি মা । গভীর আবেগে চোখ ফেটে নেমে আসতো জলের ধারা। খুব গোপনে মুছে ফেলতাম, মা টের পেতেন। মায়ের চোখেও টলমল করতো জল। আমাকে জড়িয়ে ধরে বলতেন, বোকা, কাঁদছিস কেনো?
এমনি করে একদিন সন্ধ্যায় পাশের গাঁয়ের এক নারিকেল গাছের গর্ত থেকে পেড়ে আনি একটা টিয়া পাখির ছানা। ছানাটি খুবই ছোট এবং দুর্বল। মা প্রথমে ক্ষেপে গেলেও বোধ হয় ছানাটির দুরবস্থা দেখে এগিয়ে এলেন। বললেন, তুই চিন্তা করিস না দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। এরপর চলতে থাকলো তার যত্নাদি। প্রথম দিকে কিছুই খেতে চাইতো না ও। মা বলতেন ঠিক তো মত দশা। ওর নাম রেখেছিলাম হীরা্। অল্প দিনেই হীরা বেশ হৃষ্ট-পুষ্ট হয়ে উঠলো। ডানা ঝাপটিয়ে উড়াল শিখলো, একসময় কথাও বলতে শিখলো। এরপর ওকে আর খাচায় পুরে রাখা হতো না । ঘরের কোনের ডালিম গাছটাতে সারাদিন পায়চারী করতো। কাক বা এ জাতীয় কোন বড় পাখি দেখলে হীরা ভয় পেতো। উড়ে একেবারে মায়ের কাছে গিয়ে পড়তো। ক্ষুধা পেলে অস্থির হয়ে উঠতো। অস্পস্ট স্বরে মিহি গলায় বলতো-মা ভাট ডাও, যদিও ভাত খাওয়া তার অভ্যাসে ছিল না। স্কুল থেকে বাড়ির আঙিনায় পা রাখতেই উড়ে সোজা আমার কাঁধে এসে বসতো। অবিরত টি টি শব্দে বাড়ি ঘর মাথায় তুলতো। ঠোট দিয়ে আমার কান ,চুল আলতো করে টেনে দিত। আমাকে কিছুক্ষণ না দেখলেই বিরতিহীন প্রশ্ন-রতন কই? রতন কই? অনেকবার লুকিয়ে থেকে দেখেছি তার রতনকে খোঁজা। ও ছিল আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। স্কুল ছুটি হওয়ার পর এক মুহূর্তও দেরি করতাম না। হীরা যে আমার অপেক্ষায় বসে আছে। বনবাদারে ঘোরা বন্ধ করে তখন আমি একেবারে ঘরের ছেলে। মা মজা করে বলতেন, রতন হীরা দুই ভাই ,তোদের কোন জুড়ি নাই। কোন আত্মীয়র বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া হতনা আমার, পাছে হীরাকে নিয়ে কিছু একটা ঝামেলা হয়। বন্ধুদেরও সময় দিতে পারিনা তেমন, তাদের সাথে দুরত্ব বেড়ে গেল অনেকটা। তাপরও ভাল লাগে-হীরা তো আছে। হৃদয়ে হৃদয়ে এক কঠিন বাঁধন। এভাবেই চলছিল আমাদের সংসার।
একদিন মা বাড়িতে নেই, কেবল আমি আর হীরা। হীরাকে তার ডালিম গাছে রেখে আমি স্কু্লে গেছি। টিফিন পিরিয়টে এসে হীরাকে রুটি কলা খাইয়ে গেছি। স্কুল ছুটির কিছুক্ষণ পূর্বে আকাশ কালো করে মেঘ, তারপর প্রবল বৃষ্টি সাথে ঝড়ো হাওয়া। স্যারদের নির্দেশে শ্রেণীকক্ষের দরজা জানালা বন্ধ করে আমরা সবাই ভেতরে। আমি কেবল ছটফট করছি। আমার ভেতরে আরেকটা ঝড়, দমকা হাওয়া। অনেক পরে যখন ঝড়বৃষ্টি থামলো তখন প্রায় সন্ধ্যা। আমি দ্রুত ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ছুটলাম, বন্ধুরা পেছনে ডাকছে। কথা বলার সময় নেই আমার , হীরাকে যে একলা রেখে এসেছি এমন দুর্দিনে। গেট পার হয়ে দ্রুত বাসায় পৌছি। ভয়ে ভয়ে ডালিম গাছের দিকে তাকাই। মনের মধ্যে যে আশঙ্কার সুর বেজেছিল, বোধহয় তাই হলো। হীরা নেই। বুকের ভেতরে আরেকটা ঝড় শুরু হয়, মরু ঝড়। প্যারালাইসিস রোগির মত আমার সারা শরীর অবশ হয়ে আসে। চিৎকার দেওয়ার শক্তটুকু নেই, যেন বোবা হয়ে গেছি। তন্ন তন্ন করে এক একটি ডালে খুঁজি, আশপাশের গাছগুলোতে খুঁজি। হীরা কোথাও নেই। এরপরও অনেক খুঁজেছি, হীরাকে আর কোনদিন খুঁজে পাইনি। হয়তো ঝড়ের তোরে অজানা কোথায় উড়ে গেছে অথবা কাক চিলের খাদ্য হয়েছে। ওকে হারিয়ে আমি বন্ধুহীন হয়ে গেলাম চিরতরে । ঝরের প্রচন্ড ঝাপটায় উড়ে যাওয়ার পুর্বে শেষ শক্তিটুকু দিয়ে ডালিম গাছটাকে শক্ত করে আকড়ে ধরতে ধরতে হয়ত আমাকে পাগলের মত খুঁজেছে, রতন রতন বলে চিৎকার করেছে। এখন আর কেউ অমন করে ডাকবেনা, জানতে চাইবে না- রতন কই।
এরপর প্রায়ই ডালিম গাছ থেকে শব্দ ভেসে আসতো-রতন কই? মাঝরাতে ঘুম ভাঙলেই শুনতে পেতাম হীরা ডাকছে- রতন কই? ভারি গলা, ভৌতিক স্বর। তারপর দরজা খুলে ঘর থেকে বেড়িয়ে যাই, ডালিম গাছটার নিচে গিয়ে দাড়াই। হীরাকে খুঁজতে থাকি । হঠাৎ দেখি একঝাক টিয়া টি টি করতে করতে চারদিক থেকে আমার উপর ঝাপিযে পরছে। আমি চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারাই। মা সহ পাড়া-প্রতিবেশিরা ছুটে আসে।  প্রায়ই এরকম হতে থাকল। কয়েকদিন পর ডালিম গাছটা কাটা হল । সমস্যা আরও বাড়লো। এখন আমার রুমের একেবারে কাছে এসে আরও ভয়ংকরভাবে ডাকে। যেখানে যাই সারাদিন একই শব্দ শুনি। আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। সব শুনে ডাক্তার সাহেব পরামর্শ দিলেন আমাকে দূরে কোথাও পাঠিয়ে দিতে। আরো কি একটা যেন বললেন মায়ের কাছে গোপনে। আমাকে ভর্তি করা হলো গ্রাম থেকে অনেক অনেক দূরে শহরের এক স্কুলে।

নোটঃ ২০০৭ সালে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার গল্প লেখা প্রতিযোগিতার প্রথম সেরা দশ গল্পের একটি। লেখাটি  প্রকাশিত হয়েছিল বেনামে।



রবিবার, ৮ মে, ২০১৬

তিন দশক পর


-'কেমন আছো ?'
আকস্মিক প্রশ্নে সম্বিত ফিরে পাই । চারদিকে খুব কাছাকাছি কাউকে দেখছিনা । মেঠো পথটিতে ব্যস্ত পদচারনা নেই গ্রামবাসীর । সুনসান নিরবতা সারা পথ জুড়ে ।দুই পাশের সারি সারি জারুলগাছ হতে খসে পড়ছে শুকনো পাতা । শীতের কুয়াশা নেমেছে দূরের বিলে ।মাঠ থেকে গরু নিয়ে ফিরছে রাখাল বালকেরা । ত্রিশ বছর পরেও সবকিছুই যেন আগের মত জীবন্ত, প্রাণবন্ত । বছরান্তে গ্রামে ফিরলে এই রাস্তাটা আমায় ভীষণ টানে , শেষ বিকেলের দিকে একা একা হাটি । কি যেন কতগুলো স্মৃতি জড়িয়ে আছে এখানে ।

ভাসা ভাসা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে মধ্য বয়সী এক নারী । ভাঙা কপোল, রোগা চেহারা । বয়স ঠিক অনুমান করা যাচ্ছে না । ঠোঁটের কোনে খুব সুক্ষ্ন একটা হাসি আটকে আছে । চেহারায় কষ্টের ছাপ স্পস্ট ।অভিব্যক্তি দেখে মনে হচ্ছে আমাকে ভালোভাবেই চিনে । নিশ্চিত হলাম প্রশ্নটা আমাকেই করেছে । আমি কিছুটা ইতস্তত করে জবাব দেই ।
- 'হ্যাঁ ভালো । আপনি কেমন আছেন ?'
ঠোটের কোনায় লেগে থাকা হাসিটুকু মুছে যায় খুব ধীরে ।
-'তুমি বোধহয় আমাকে চিনতে পারোনি ।'
-'স্যরি , আসলে চশমাটা...'
আমার কথা শেষ না হতেই গরগর করে বলে যায়
-'আমি শশী । মনে আছে , একসাথে নাগের পাড়া হাইস্কুলে পড়তাম ।'
ও চোখ সরিয়ে নেয় । আমার হৃদপিন্ড কেঁপে উঠে । কণ্ঠনালী শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসে । সারাটা জীবন ধরে যাকে খুঁজেছি , তাকে এই ভাবে দেখতে হবে ভাবতে পারিনি । দৃষ্টির সমস্ত আলো জ্বেলে শশীকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখি । এইতো সেই চোখ, নাকের ডগায় জমে উঠা শিশির কনার মত বিন্দু বিন্দু ঘাম । সারাটা জীবন ধরে এই চোখ জোড়াই খুঁজেছি । অপেক্ষায় থেকেছি এতকাল । অথচ সামনা সামনি দাঁড়ানো ওকে আজ চিনতে পারিনি ; কতটা বদলে গেছে ও । সময় সবকিছু কিভাবে বদলে দেয় ! শশীর চোখদুটো কেমন ছলছল করে উঠে । কি এক অদৃশ্য কষ্টে বুকটা দুমড়ে মুচড়ে আসে আমার । কতগুলো ঢেউ আছড়ে পড়তে থাকে সজোরে হৃদপিন্ডের প্রাচীরে । দক্ষ হাতে নিজেকে সামলে নেই ।

-'তারপর কি হলো শশী ? কোথায় ছিলে তুমি ? ভাল ছিলে তো ?'
শশী নিশ্চুপ । ওকে দেখে আর বুঝতে বাকি থাকে না, কি রকম আছে ও । ও কি বুঝতে পেরেছে কোট প্যন্টের মাঝে পরিপাটি মানুষ আমিও ভাল নেই ! হয়তো বোঝে, হয়তো বোঝে না । ঠোটের কোনে সেই হাসিটুকু আনার আপ্রাণ চেস্টা ।
-'বাদ দাও ওসব । বল তোমার বউ, ছেলে-মেয়ে কেমন আছে ।'
আর কোন চোখ যে আমার মনেই ধরেনি । অমন হাসির ছটায় ভরায়নি প্রাণ । খুঁজে দেখতে যাইনি কি ভাল কি মন্দ । সেই চোখের অপেক্ষায় থেকে থেকে আমার যে কবেই দুপুর গড়িয়ে গেছে সে কথা হয়তো জানে না শশী । নাইবা জানুক । মাথা নেড়ে জবাব দেই
-'হ্যাঁ সব ভালো ।'
ত্রিশ বছর আগের মতই সরল চোখে চেয়ে থাকে শশী ।স্মৃতিরা পাখা মেলে দেয় পুরানের পথে, ভালো লাগার প্রথম প্রহরে ।

শনিবার, ৭ মে, ২০১৬

দায়

হ্যাঁ । অবন্তির কথাই বলছি ।আমার পরিচিতজনরা সবাই অবন্তির কথা জানে, আপনারা যারা জানেন না তারাও আজকের পর থেকে জানবেন ।

শেষ পর্যন্ত যখন অবন্তি রাজি হল না তখন আমি হাল ছেড়ে দিয়ে একপ্রকার অনুভূতিহীন হয়ে পড়লাম ।অবন্তির বিয়ে হয়ে গেল । আমি বন্ধুবান্ধবসমেত ভরপেট দাওয়াত খেয়ে আসলাম । রাসেল , তমালরা অবশ্য অবন্তিকে তুলে আনার প্রস্তাব দিয়েছিল , আমিই রাজি হইনি । মনের শিকলে যাকে বাঁধতে পারিনি, লোহার শিকলে তাকে বেঁধে কি লাভ ? সদ্য পাশ করা বেকার যুবক আমি , একটা পরিবার বুভুক্ষের মত আমার দিকে চেয়ে আছে , একটা চাকরি যোগার করে যখন তাদের মুখে হাসি ফোটানো দরকার, বৃদ্ধ বাবার কাঁধ থেকে সংসারের জোয়াল যখন কাঁধে নেয়া দরকার তখন কি আর কাউকে তুলে এনে বিয়ে করার মত সঙ্গতি থাকে ? তাও যদি পাত্রী রাজি থাকে, না হয় একটা কথা থাকে । আট বছরের সম্পর্ক বেমালুম ভুলে গিয়ে যে হাসিমুখে বিয়ের আসরে বসতে পারে, তার কাছে করুনার পাত্র হতে কে চায় ? অন্তত আমি চাই না ।ধরুন, অবন্তিকে আমি কোনদিন ভালোই বাসিনি , ভালবাসলে কি আর এভাবে চুপচাপ দাড়িয়ে থেকে তার বিয়ে হয়ে যাওয়া দেখতে পারি ? বিয়ে বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া, হৈ-হুল্লোর করে কাটাতে পারি ? অবন্তি এটাই জানুক ।
যদি কোনদিন কোন এক টুকরো সুখের স্মৃতি মনে এসে ওর চোখ ছলছল করে ওঠে , অপরাধবোধ কান্না হয়ে গলার কাছে এসে দলা পাকিয়ে যায় , সেদিন এটাই হবে ওর সান্ত্বনা ।ভালোবাসার দায় থেকে মুক্তির পথ ।

শেষের কবিতার পরের কবিতা

মেয়েটির নাম লাবণ্য আমার ছাত্রী আমি ওকে পদার্থবিজ্ঞান আর গণিত পড়াই সপ্তাহে তিন দিন, সন্ধ্যে ৭টা থেকে রাত ৮টা ভাল ছাত্রী ছাত্রীর রূপের বর্ণনা দেয়া শিক্ষকের জন্য শোভনীয় নয় তাই সৌন্ধর্যের বিষয়টা উহ্যই থাকুকতবে বর্ণনা করতে গেলে আমাকে জীবনানন্দ হতে হতো আমার মনে হয় একমাত্র জীবনানন্দ ছাড়া তার লাবণ্যের নিখুঁত ছবি আর কেউই আঁকতে পারবে না আমি শামুক প্রজাতির মানুষ, ভেতরে মাখনের মতো নরম হলেও বাইরে একটা শক্ত খোলস আটকে রাখিতাই সহজে কারো সাথে মিশতে পারিনা, মানুষও আমার সাথে খুব একটা মিশে না তবে যার সাথে জমে উঠে তার সাথে খোলস ভেঙ্গে ফেলি
দু মাস না পেরুতেই তার সাথে সম্পর্কটা বেশ সহজ হয়ে এলো অনেক কথাই হয়, ক্যারিয়ার, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি সব তার পারিপার্শিক জ্ঞান, সচেতনতা, বাচন ভঙ্গি আমাকে মুগ্ধ করে সবচেয়ে বেশি অভিভূত হই তার নিরবতা আর ব্যক্তিত্বে
আজ পাঁচ মাস পূর্ণ হলো, লবণ্যের পদার্থবিজ্ঞান গণিতের কোর্স শেষ কয়েকদিন পরেই উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু হবে সংগত কারণে আমারও আজ শেষ লেকচার
-স্যার, শেষের কবিতা পড়েছেন?
-পড়েছি অনেকবছর আগে
-লাবণ্যকে মনে আছে?
-আছে
-
আমি সেই লাবণ্য অমিতকে ভালবাসি, তবে তাকে বিয়ে করতে চাই না একজন শোভনলালকে খুঁজছি স্যার আপনি শোভনলাল হতে পারবেন?