Translate

মঙ্গলবার, ২ অক্টোবর, ২০১৮

চিঠি

জীবনে প্রথম প্রেমে পরেছিলাম যে মেয়েটির তাকে সে কথা কখনো বলা হয়নি । সদ্য মাধ্যমিক পেরিয়ে তখন ভর্তি হয়েছি শহরের নাম করা কলেজে । প্রথম ক্লাসেই সেই অঘটন ঘটে গেল, জীবনে প্রথম প্রেমে পড়লাম । কলেজের প্রথম দিন প্রথম ক্লাসে কলেজের অধ্যক্ষ আর নামি দামি প্রফেসররা আসবেন, সবার সাথে পরিচিত হবেন, নতুন ছাত্রদের বরণ করবেন, সে এক এলাহী কান্ড। আমি গ্রাম থেকে উঠে আসা গোবেচারা মানুষ, সামনের সারিতে বসার সাহস হলো না । ভয়ে ভয়ে দ্বিতীয় সারিতে বসে গেলাম । যথারীতি প্রোগাম শুরু হলো । হলরুমে পিন পতন নিরবতা। অধ্যক্ষ মহোদয় কথা শুরু করলেন । মনোযোগ দিয়ে শুনছি । বাইরে অবিরাম বৃষ্টি ঝরছে । সামনের জানালা দিয়ে অবিরল জলের ধারার ন্যায় বাতাস বইছে । একগুচ্ছ গভীর কালো চুল সেই বাতাসে ভেসে আমার চোখ মুখ ছুঁয়ে যাচ্ছে । সদ্য স্নান করে আসা চুলের ঘ্রাণ আর আলতো ছোঁয়ায় কখন যে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি সে আমার জানা নেই । যখন টের পেয়েছি তখন পুরো ক্লাস আমার দিকে তাকিয়ে হাসি আটকাচ্ছে । পরিচিতি পর্বে সবাই যখন নিজের পরিচয় দিচ্ছে, আমি তখন বলছি... চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা।

মুগ্ধতার রেশ কটিয়ে নিজের পরিচয় দিতে খানিকটা সময় লেগেছে সেদিন । মেয়েটি আমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে ঠোটের কোনায় বিপ্রতিপ হাসি এঁকে রাজহংসীর ন্যায় ঘাড় ঘুরিয়ে চুলগুলো সামলে নিল । তবু আমার চোখে মুখে এক অসীম মুগ্ধতার আবেশ রয়ে গেল । আমি প্রেমে পড়লাম । প্রথম দেখায় যে মানুষ প্রেমে পড়ে, সেবার প্রথম আমার বিশ্বাস হলো।

এরপর প্রতিদিন আমি তার ঠিক পেছনটায় বসেছি, সে চুল খোলা রেখেছে, আমি ঘ্রাণ নিয়েছি, মাতাল হয়েছি। তার সাথে কোন কথা হয়নি। চোখাচোখি হয়েছে, সে হেসেছে আমি হাসিতে তার উত্তর দিয়েছি। কোন কথা না বলেই অনেক কথা হয়ে যেতো।

আমি বহুদিন তাকে ভালোবাসি বলবো বলে তার কাছাকাছি গিয়েছি, লজ্জা আর ভয় মেশানো অদ্ভুত এক অনুভূতি নিয়ে ফিরে এসেছি। ভালোবাসি বলা হয় নি । একবার সে কাছে ডেকে বলেছিল, কিছু কি বলতে চাও আমায়? আমি জবুথবু হয়ে বলেছিলাম, না তো! কি বলার আছে, কিচ্ছু না ।
প্রথম সেমিস্টার ব্রেক হলো , এরমধ্যে বেশ কিছু দিন অসুস্থ ছিলাম । সেবার বাড়ি থেকে প্রতিজ্ঞা করে কলেজে গেলাম । যে কোরেই হোক তাকে বলতে হবে -আমি কিছু বলতে চাই । তোমাকে ভালোবাসি একথা বলতে চাই। কলেজের প্রথম আওয়ারেই তাকে বলে দেব।

সারারাত অনুশীলন, মনের ভেতর কত যে আকুলিবিকুলি, একফোঁটা ঘুম আসেনি সে রাতে । আমি সেই নির্দিষ্ট আসনে বসা, শুভা আসবে, আমার সামনের আসনটাতে বসবে, খোলা হাওয়ায় তার এলো চুল উড়বে, আমার চোখে মুখে ছুঁয়ে যাবে । আমি ভালোবাসায় বিভোর হব, চোখ বন্ধ করে আবার মাতাল হবো। অনেক দিন পর আবার আমি স্বপ্নে হারাবো। তাকে ছাড়া যে আমার একেবারেই চলবে না, তারপর তাকে সে কথা বলে দেব।

শুভা এলো না এলো শ্রাবনী। আমার হাতে এক টুকরো কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলল -শুভার চিঠি । আহ্ তাহলে সেও বুঝি ভালোবাসে! লজ্জায় নিজেকে আড়াল করেছে বুঝি! লজ্জা নারীর ভূষণ কি না ! জীবনে প্রথম কোন প্রেমিকার চিঠি আমার হাতে । আহ সেও বুঝি আমারি মত অপেক্ষায় গুনেছে দিন! আনন্দের সকল সীমা ছাড়িয়ে আমি এক অদ্ভুত শিহরণ অনুভব করলাম। এরই নাম বুঝি প্রেম!

কাপাকাপা হাতে চিঠি খুললাম। একটি বাক্য শুধু "ভালো থেকো অরুন" । শ্রাবনী জানালো শুভার বিয়ে হয়ে গেছে । সেদিন ভরা ক্লাসে বাচ্চাদের মত আমি হাউমাউ করে কেঁদেছি। এখনো মনে আছে পুরো ক্লাস আমার দিকে চেয়ে থেকেছিল।

আঠারো বছর পর আজ আবার তার সাথে দেখা। অফিসার্স ক্লাবে, আমাদের পারিবারিক ফাংশনে। তার সাহেব কদিন আগেই এডিশনাল ডিআইজির পদে প্রোমোশন নিয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে যোগদান করেছেন। আমার সরাসরি বস । তার সাথে নতুন করে আলাপ হলো। স্যার পরিচয় করিয়ে দিলেন আমাদের তরুণ, সাহসী অফিসার, সিনিয়র এএসপি অরুণ । স্যার হো হো করে হাসতে হাসতে বললেন, চিরকুমার সংঘের সদস্যও বলতে পারো। আমি সালাম দিলাম, সে মুচকি হাসলো তার পর চোখ থেকে চোখ নামিয়ে নিলো। বিশ্বাস করুন সে হাসিতে কোনো প্রাণ ছিল না । দু চারটা ফরমাল কথা হলো । মেঘের আড়ালে ঢাকাপরা চাঁদের মত একরাশ বিষণ্ণতা তার অবয়ব জুড়ে নেমে এলো। আমি সরে এলাম, কত আর অভিনয় করা যায়!

জানি এর কোন কার্যকরণ হবেনা, তবু আঠারো বছর বুকের ভেতর বয়ে বেড়ানো কথাটা কি তাকে বলা যায় না? অন্তত সে জানুন কেউ একজন এখনো তাকে ভালোবাসে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

ধন্যবাদ