
পড়ায় মন বসাতে
পারছি না। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। হঠাৎ করেই বুকের মধ্যে শুরু হয় তুষার ঝড়। ঠান্ডা
বাতাসের ঝাপটায় কেঁপে কেঁপে ওঠে হৃদপিন্ডের কোমল প্রাচীর। রক্তের সাথে মিশে দেহের
অলিতে গলিতে পৌছে। শরীর হিম হয়ে আসে। আমি অস্থির হয়ে উঠি। নাহ্ আর বসে থাকা যায় না,
চেয়ার ছেড়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াই। রেলিংটাকে দুই হাতে শক্ত করে ধরি। হন্যে হয়ে খুঁজি
চারপাশে। কোথাও নেই।
দশজনের মেস, পুরোপুরি
ফাঁকা। বড়রা সবাই বা্ইরের কাজে ব্যস্ত। এ সময়টা আমাকে একাই থাকতে হয়। দূরের আকাশে উড়ছে
একটি চিল, সোনালী চিল, একাকি। শেষ বিকেলের নিস্প্রভ রোদ্দুরে পৃথিবীটা বড় বিষণ্ণ লাগে।
কিছুক্ষণ পিনপতন
নিরবতা। আবার সেই শব্দ। কান খাড়া করি। চোখ দুটি ব্যাকুল হয়ে খোঁজে। দৃষ্টিরা ফিরে আসে
ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে। কবে সে মরে গিয়ে, পঁচে গিয়ে, মাটির সাথে মিশে গেছে হয়তো। এখনও
সে আসে, জ্বালাতন করে, সুযোগ পেলেই মাথার ভেতরে বসে থেকে থেকে ডেকে চলে। কেন যে এত
বেশি ভালবাসতে গেলাম তাকে। নস্টালজিক হয়ে পরি। স্মিৃতির ভেলায় ভেসে যাই তিন বছর আগের
এক দুরন্ত দিনে।
ক্লাস
সিক্সে পড়ি। পড়াশুনা তেমন ভাল লাগেনা। নিয়ম মাফিক কোন কাজই আমার পছন্দ নয়। ভাল লাগে
পথে-প্রান্তরে ঘুরে বেড়াতে, চৈত্রের দুপুরে সবার অলক্ষ্যে পুকুরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডুবসাতার
কিংবা দলবেঁধে ঝাপিয়ে পড়তে আড়িয়ালখাঁর ঘোলা জলে। প্রায়ই স্কুল পালিয়ে গ্রামের বন-বাঁদারে
ঘুড়ে বেড়াই, পাখিদের কলকাকলি শুনি, খুঁজে বেড়াই টিয়া, শালিক, ঘুঘু, সোনাঘুঘু, মাছরাঙা
আরও কত কি! নারিকেল গাছের গর্তে বাসা বাঁধে টিয়া, শালিক পাখিরা; মাছরাঙারা বাঁধে নতুন
পুকুরের পাড়ে মাটিতে গর্ত করে আর ঘন ঝোপঝারের মধ্যে ঘুঘু পাখিরা। এসব মুখস্থ। কিন্তু
শিতের শুরুতে যে নানান রঙের পাখিরা এসে মুগ্ধ করতো সারা বিল, তাদের কারো নাম জানা হতো
না, জানা হতো না কোথায় তারা বাসা বাঁধে। কাউকে জিজ্ঞেস করা হয়নি কখনো। শুধু মনে মনে
খুঁজেছি। আশপাশের দু-চার গ্রামও বাদ পড়তো না পাথির বাসা খুঁজতে। সারাদিন ঘুরে ঘুরে
ক্লান্ত হয়ে সন্ধ্যায় ফিরতাম দু-চারটা পাখির ছানা হাতে নিয়ে উৎফুল্ল মনে। মা ভীষণ রেগে
যেতেন। বলতেন, তপুর কাছে শুনলাম স্কুলে যাসনি। কোথায় ছিলি সারাদিন? দুপুরে কি খেয়েছিস?
আর এই আপদগুলো কোথেকে ধরে নিয়ে এসেছিস? এরকম বাদরের মতো সারাদিন ঘুরে বেড়াস। তোদের
সাথে আমি আর থাকব না। কালই চলে যাব -দুচোখ যেদিকে যায়। আমার হৃদয় আনচান করতো, কেমন
যেন হয়ে যেতাম। সারা দিনের অপরাধের গ্লানি আমার মাথায় বোঝা হয়ে উঠতো। অধঃমুখে বিষণ্ণ
মনে দাড়িয়ে থাকতাম। কিছুক্ষণ পর মা কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতেন-লক্ষী বাবা
আমার, আর এমনট করিস না। যা হাত মুখ ধুয়ে আয়, ভাত খাবি। ধরা গলায় বলতেন-না খেয়ে খেয়ে
কি অবস্থা হয়েছে তোর, দেখেছিস! আমি প্রভুভক্ত বিড়ালের মতো মায়ের কোল ঘেষে বসতাম। মনে
মনে বলতাম, তুমি আমার মা… তোমাকে অনেক ভালবাসি মা । গভীর আবেগে চোখ ফেটে নেমে আসতো
জলের ধারা। খুব গোপনে মুছে ফেলতাম, মা টের পেতেন। মায়ের চোখেও টলমল করতো জল। আমাকে
জড়িয়ে ধরে বলতেন, বোকা, কাঁদছিস কেনো?
এমনি
করে একদিন সন্ধ্যায় পাশের গাঁয়ের এক নারিকেল গাছের গর্ত থেকে পেড়ে আনি একটা টিয়া পাখির
ছানা। ছানাটি খুবই ছোট এবং দুর্বল। মা প্রথমে ক্ষেপে গেলেও বোধ হয় ছানাটির দুরবস্থা
দেখে এগিয়ে এলেন। বললেন, তুই চিন্তা করিস না দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। এরপর চলতে থাকলো
তার যত্নাদি। প্রথম দিকে কিছুই খেতে চাইতো না ও। মা বলতেন ঠিক তো মত দশা। ওর নাম রেখেছিলাম
হীরা্। অল্প দিনেই হীরা বেশ হৃষ্ট-পুষ্ট হয়ে উঠলো। ডানা ঝাপটিয়ে উড়াল শিখলো, একসময়
কথাও বলতে শিখলো। এরপর ওকে আর খাচায় পুরে রাখা হতো না । ঘরের কোনের ডালিম গাছটাতে
সারাদিন পায়চারী করতো। কাক বা এ জাতীয় কোন বড় পাখি দেখলে হীরা ভয় পেতো। উড়ে একেবারে
মায়ের কাছে গিয়ে পড়তো। ক্ষুধা পেলে অস্থির হয়ে উঠতো। অস্পস্ট স্বরে মিহি গলায় বলতো-মা
ভাট ডাও, যদিও ভাত খাওয়া তার অভ্যাসে ছিল না। স্কুল থেকে বাড়ির আঙিনায় পা রাখতেই উড়ে
সোজা আমার কাঁধে এসে বসতো। অবিরত টি টি শব্দে বাড়ি ঘর মাথায় তুলতো। ঠোট দিয়ে আমার কান
,চুল আলতো করে টেনে দিত। আমাকে কিছুক্ষণ না দেখলেই বিরতিহীন প্রশ্ন-রতন কই? রতন কই?
অনেকবার লুকিয়ে থেকে দেখেছি তার রতনকে খোঁজা। ও ছিল আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। স্কুল
ছুটি হওয়ার পর এক মুহূর্তও দেরি করতাম না। হীরা যে আমার অপেক্ষায় বসে আছে। বনবাদারে
ঘোরা বন্ধ করে তখন আমি একেবারে ঘরের ছেলে। মা মজা করে বলতেন, রতন হীরা দুই ভাই ,তোদের
কোন জুড়ি নাই। কোন আত্মীয়র বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া হতনা আমার, পাছে হীরাকে নিয়ে কিছু একটা
ঝামেলা হয়। বন্ধুদেরও সময় দিতে পারিনা তেমন, তাদের সাথে দুরত্ব বেড়ে গেল অনেকটা। তাপরও
ভাল লাগে-হীরা তো আছে। হৃদয়ে হৃদয়ে এক কঠিন বাঁধন। এভাবেই চলছিল আমাদের সংসার।
একদিন
মা বাড়িতে নেই, কেবল আমি আর হীরা। হীরাকে তার ডালিম গাছে রেখে আমি স্কু্লে গেছি। টিফিন
পিরিয়টে এসে হীরাকে রুটি কলা খাইয়ে গেছি। স্কুল ছুটির কিছুক্ষণ পূর্বে আকাশ কালো করে
মেঘ, তারপর প্রবল বৃষ্টি সাথে ঝড়ো হাওয়া। স্যারদের নির্দেশে শ্রেণীকক্ষের দরজা জানালা
বন্ধ করে আমরা সবাই ভেতরে। আমি কেবল ছটফট করছি। আমার ভেতরে আরেকটা ঝড়, দমকা হাওয়া।
অনেক পরে যখন ঝড়বৃষ্টি থামলো তখন প্রায় সন্ধ্যা। আমি দ্রুত ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ছুটলাম,
বন্ধুরা পেছনে ডাকছে। কথা বলার সময় নেই আমার , হীরাকে যে একলা রেখে এসেছি এমন দুর্দিনে।
গেট পার হয়ে দ্রুত বাসায় পৌছি। ভয়ে ভয়ে ডালিম গাছের দিকে তাকাই। মনের মধ্যে যে আশঙ্কার
সুর বেজেছিল, বোধহয় তাই হলো। হীরা নেই। বুকের ভেতরে আরেকটা ঝড় শুরু হয়, মরু ঝড়। প্যারালাইসিস
রোগির মত আমার সারা শরীর অবশ হয়ে আসে। চিৎকার দেওয়ার শক্তটুকু নেই, যেন বোবা হয়ে গেছি।
তন্ন তন্ন করে এক একটি ডালে খুঁজি, আশপাশের গাছগুলোতে খুঁজি। হীরা কোথাও নেই। এরপরও
অনেক খুঁজেছি, হীরাকে আর কোনদিন খুঁজে পাইনি। হয়তো ঝড়ের তোরে অজানা কোথায় উড়ে গেছে
অথবা কাক চিলের খাদ্য হয়েছে। ওকে হারিয়ে আমি বন্ধুহীন হয়ে গেলাম চিরতরে । ঝরের প্রচন্ড
ঝাপটায় উড়ে যাওয়ার পুর্বে শেষ শক্তিটুকু দিয়ে ডালিম গাছটাকে শক্ত করে আকড়ে ধরতে ধরতে
হয়ত আমাকে পাগলের মত খুঁজেছে, রতন রতন বলে চিৎকার করেছে। এখন আর কেউ অমন করে ডাকবেনা,
জানতে চাইবে না- রতন কই।
এরপর
প্রায়ই ডালিম গাছ থেকে শব্দ ভেসে আসতো-রতন কই? মাঝরাতে ঘুম ভাঙলেই শুনতে পেতাম হীরা
ডাকছে- রতন কই? ভারি গলা, ভৌতিক স্বর। তারপর দরজা খুলে ঘর থেকে বেড়িয়ে যাই, ডালিম গাছটার
নিচে গিয়ে দাড়াই। হীরাকে খুঁজতে থাকি । হঠাৎ দেখি একঝাক টিয়া টি টি করতে করতে চারদিক
থেকে আমার উপর ঝাপিযে পরছে। আমি চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারাই। মা সহ পাড়া-প্রতিবেশিরা ছুটে
আসে। প্রায়ই এরকম হতে থাকল। কয়েকদিন পর ডালিম
গাছটা কাটা হল । সমস্যা আরও বাড়লো। এখন আমার রুমের একেবারে কাছে এসে আরও ভয়ংকরভাবে
ডাকে। যেখানে যাই সারাদিন একই শব্দ শুনি। আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। সব
শুনে ডাক্তার সাহেব পরামর্শ দিলেন আমাকে দূরে কোথাও পাঠিয়ে দিতে। আরো কি একটা যেন বললেন
মায়ের কাছে গোপনে। আমাকে ভর্তি করা হলো গ্রাম থেকে অনেক অনেক দূরে শহরের এক স্কুলে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
ধন্যবাদ