মৌমিতা সেজেগুজে শান্তিনগর থেকে বেইলি রোড হয়ে সোজা রমনার দুই নম্বর গেটে
এসে যখন দাড়ায় তখন ঘড়িতে দশটা ছুঁইছুঁই। সুমিতের সাথে আজ ১০টায় দেখা
করার কথা। মৌমিতা হাত উল্টিয়ে বারবার ঘড়ি দেখছে। এখন ১১টা বেজে আঠার
মিনিট অথচ সুমিতের আসার নাম নেই। সুমিত বরাবরই লেট, তবে তা পাঁচ-দশ মিনিটের
বেশি গড়ায় না। বেশ কয়েক মাস ধরেই এমনটা হচ্ছে। জিজ্ঞেস করলে বিভিন্ন
এক্সকিউজ দেখায়। সুমিত কি তাকে এড়িয়ে যেতে চাইছে! না কি অন্য কিছু?
মৌমিতা এই এক ঘন্টায় ফোনে বিশ বারের বেশি ট্রাই করেছে। সুমিতের ফোন
ব্যস্ত। আর এখন বন্ধ। কি হল সুমিতের? এতক্ষণ সুমিতের উপর যে রাগ উঠেছিল এখন
তা দুশ্চিন্তায় পরিনত হল। এই রহস্যময় শহরের কোন বাকেঁ কোন অমঙ্গল ওঁত
পেতে আছে কেউ জানে না। অজানা সঙ্কায় মৌমিতার বুকটা হু হু করে উঠলো।
হাই আপি! কি খবর? এখানে দাড়িয়ে কেন?
রাহাত। সুমিতের পাশের বাসায় থাকে। এদিক দিয়েই যাচ্ছে, হঠাৎ মৌমিতার সাথে
দেখা। মৌমিতা হাত উল্টে ঘড়ি দেখে এরপর ওষ্ঠযুগলে সামান্য হাসির আভা
ছড়িয়ে দিয়ে বলে, সুমিত আসার কথা। সেই হাসির রেখা ওষ্ঠযুগলেই বিষন্নতায়
মিলিয়ে যায়।
আসেনি? ব্যাপার কি বলুন তো! দাদাকে তো দেখে এলাম বাটা
সিগনালের পাশে, এলিফ্যান্ট রোডের একটি কানা গলির ভেতরে। সাথে একটা মেয়ে,
বেশ সুন্দরী। দুজনকেই বেশ ভীত-সন্ত্রস্ত মনে হল। গুটিসুটি মেরে দাড়িয়ে,
সাবধানে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। মেয়েটির চোখে চোখ পড়েছিল। ভয় পাওয়া হরিন
শিশুর মত চোখ সরিয়ে নিয়েছে। একে আগেও হয়তো কোথাও দেখেছি। কার সাথে ঠিক
মনে নেই।
রাহাতের কথা শেষ হওয়ার আগেই মৌমিতার মাথায় চক্কর দিয়ে ওঠে।
মৌমিতা মাটিতে পরে যেতে পারতো, কিন্তু পরলো না, শক্ত হয়ে দাড়িয়ে রইলো।
হাতের ইশারায় একটা রিকশা ডেকে উঠে বসলো। বাটা সিগনাল। রিকশাওয়ালা শুনলো
কি শুনলো না বোঝা গেল না, ঘার ঘুরিয়ে মৌমির দিকে তাকালো। মৌমিতা আবার বললো
বাটা সিগনাল। রিকশা হাতিরপুলের ভেতরের রাস্তা দিয়ে বাটা সিগনালে ডাচবাংলা
ব্যাংকের অপজিটে এসে থামে।
একটু দূরেই সুমিত রাস্তা পার হচ্ছে, সাথে
মেয়েটি। মৌমিতার চোখ আটকে আছে সুমিতের দিকে। ওরা এখন গলির তৃতীয় বাড়িটির
ঠিক সামনে এসে দাড়িয়েছে। মৌমিতা ওদের চোখ এড়িয়ে সন্তপর্ণে রাস্তা
পেরুলো। মেয়েটি সামনে সুমিত পেছনে, শা শা করে দ্রুত উঠে পড়লো দোতালা
বাড়িটির দ্বিতীয় তলায়। উপরে বড় করে একটা সাইনবোর্ড টাঙানো, ‘কাজী
অফিস’। মৌমিতা ভবনটির নিচে এসে দাড়ালো। কেমন যেন একটা শিতল শিহরন তার পা
থেকে সারা শরীর হয়ে মাথা অব্দি ছেয়ে গেল। থরথর করে কাঁপছে মৌমিতা। মৌমিতা
কাজী অফিসে ঢুকবে, না কি ঢুকবে না? বুকের ভেতরে একরাশ কষ্ট আর ঘৃণা দলা
পাকিয়ে আসে। সামান্য অবহেলা যার চোখে কান্নার সাগর নিয়ে আসে আজ তার চোখে
কোন পানি নেই। থাক না, বাঁধা দিয়ে কি লাভ? আপন সুখের পথ বেছে নেয়ার
অধিকার প্রত্যেকেরই আছে, থাকা উচিত। এই রিকশা যাবে? মৌমিতা একটা রিকশা ডেকে
উঠে পড়লো। শান্তিনগর।
সকাল সাড়ে নয়টা। সুমিত রেডি হচ্ছে। ফোনটা
বেজে উঠলো। মৌমিতা বোধ হয় বেরিয়ে পরেছে। ওর স্বভাবই এরকম, বাসা থেকে পা
ফেলেই ননস্টপ ফোন দেয়া শুরু করে। কতবার যে নিষেধ করেছি, কে শোনে কার কথা?
সুমিত ফোনটা বের করে। না। মৌমিতা নয়। রাসেদের ফোন। রাসেদ সুমিতের কাছের
বন্ধু। সুমিত ফোনটা রিসিভ করে। হঠৎ একটা বড় রকম বিপদে পরে গেছি দোস্ত।
বলিস কি? কি হয়েছে? বলছি, একটা টেক্সি নিয়ে দ্রুত এলিফেন্ট রোডে চলে আয়
কুইক। এই আমার আজ তাড়া আছে, জরুরী এপয়েনমেন্ট। আরে রাখ তোর এপয়েনমেন্ট,
আমার জীবন মরন সমস্যা, এক সেকেন্ড দেরি করলে আমার সর্বনাশ হয়ে যাবে। রাসেদ
বিস্তারিত বলতে থাকে। সুমিত কথা বলতে বলতে একটা টেক্সি ডেকে উঠে পড়লো ।
ওদের বিয়ে শেষ হল রাত ১২ টার দিকে। বিয়ের পর রাশেদ আর সোমাকে নিরাপদে
পৌছে দিয়ে সুমিতের ফিরতে প্রায় দেড়টা বেজে গেল। আড়াইটার দিকে সুমিতের
অটপসি ক্লাস। স্টুডেন্টরা অপেক্ষা করবে। সুমিত ফোনটা অন করে মৌমিতাকে ট্রাই
করে। মৌমিতার ফোন বন্ধ। সুমিতের মন খারাপ হয়ে যায়, বেচারি না জানি
কতক্ষন একা একা দাড়িয়ে থেকেছে, অপেক্ষা করেছে। কিন্ত কি করার ছিল তখন?
সোমা যেভাবে বাসা থেকে পালিয়েছে! ধরা পরে গেলে দুজনের লাইফই বরবাদ হবার
আশঙ্কা ছিল। ক্লাস শেষে যে করেই হোক মৌমির সাথে একবার দেখা করতে হবে।
ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললে আশাকরি মৌমি ভুল বুঝবে না। ভাবতে ভাবতে সুমিত
কলেজের গেটে এসে পৌছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ। লাশঘরের বাইরে একজন এসআইর
নেতৃত্বে কয়েকজন উর্দী পড়া কনস্টাবল দাড়িয়ে। ভেতরে স্টুডেন্টদের জটলা,
কানাকানি। এরা সব ফোর্থ ইয়ারের স্টুডেন্ট। সুমিত লাশঘরে প্রবেশ করলো।
একটা নতুন লাশ এসেছে। ২০ -২২ বছর বয়সের তরুনী। গলায় ফাঁস নিয়েছে।
ঘন্টাখানেক আগে এসেছে লশটা। পরনে নীল শাড়ি, শাড়ির সাথে ম্যাচিং করা
ব্লাউজ, কপালে নীল টিপ, খোলা চুল পরিপাটি করে আচঁড়ানো। ভ্রু যুগল গাঙচিলের
ডানার মত চোখের দুই দিকে নেমে গেছে। কাজল মাখা চোখ জোড়া বন্ধ করা না
থাকলে হয়ত দিঘির মতো গভীর চোখের মায়া ছড়িয়ে পড়তো এই লাশকাটা ঘরটায়।
নিষ্পাপ ওষ্ঠযুগলে বেদনার বিন্দুমাত্র ছাপ নেই, মনে হয় এইমাত্র হাসতে
হাসতে ঘুমিয়ে পড়েছে।
দক্ষিন এশিয়ার অঞ্চলের মেয়েদের আত্মহত্যার প্রবনতা
বেশি, এর বিভিন্ন কারণও রয়েছে। তবে ধনাট্য পরিবারের সুন্দরী, শিক্ষিত কোন
মেয়ের আত্মহনন একেবারে বেমানান। শিশির ভেজা ফুলের মত নিস্পাপ সুন্দর
মেয়েটা সেজেগুজে কেন আত্মহননের পথ বেছে নিলো? কি এমন ঘটেছিল? এই প্রশ্ন
সবার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ছাত্রছাত্রীরা তরুন শিক্ষককে পথ করে দিল। সুমিত
লাশটির সামনে এসে দাড়ালো। লাশটি একটি লোহার খাটের উপর চিৎ করে শোয়ানো।
মাংসের দোকানিরা যেরকম কাঠের গুড়িতে মাংস বানায়, মাথার নিচে বালিশের
পরিবর্তে সেরকম এক টুকরো শুকনো কাঠ। লাশটি একটা সাদা কাপড় দিয়ে আপদমস্তক
ঢেকে রাখা হয়েছে। হাতুরি, বাটাল আর ধারালো ছুরি নিয়ে ডোম প্রস্তুত। যে
ডোম সম্প্রদায় নির্লিপ্তভাবে মানুষের লাশ কেটে অভ্যস্ত, এই লাশটা বোধহয়
তার মনেও দাগ কেটেছে ।
লাশের উপরের কাপড়টা টেনে সরিয়ে দেয়া হল,
স্টুডেন্টরা লাশের চারদিকে এসে জড়ো হলো। ডা. সুমিতের চোখ লাশের মুখোমন্ডল
বরাবর পরতেই বিদ্যুৎস্পৃষ্ট মানুষের মত তার আপদমস্তক কেঁপে উঠলো। এরপর মৌমি
বলে একটা চিৎকার দিয়ে পাথরের ন্যায় দাড়িয়ে রইলো।।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
ধন্যবাদ